দেশের ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক
হিসেবে খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি ছিনতাইকারী চক্র আবারো সক্রিয়
হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ফেনীর ফাজিলপুরে লরি ভর্তি ৩৫ টন রড ছিনতাইয়ের পর
অনুসন্ধানে নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সূত্র জানিয়েছে, গত এক বছরে শতাধিক
গাড়ি ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৪০ জন গাড়ির চালক ও
হেলপার। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম পরিবহন
মালিক সমিতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিবহন সেক্টরে ছিনতাই-খুনসহ নৈরাজ্য
সৃষ্টির প্রতিবাদে আয়োজিত সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম
মহাসড়ক পরিণত হয়েছে ছিনতাইকারীদের নিরাপদ রুটে। বিশাল এ এলাকাকে কেন্দ্র
করে গড়ে উঠেছে বেশ ক’টি ছিনতাইকারী সিন্ডিকেট। ওইসব সিন্ডিকেটে যোগ দিয়েছে
মহাসড়কের আশপাশের এলাকার বেকার যুবকরা। মাঝে মধ্যে কয়েক ছিনতাইকারী আইন
প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হলেও তাদের মুখ থেকে কোনো তথ্য বের না
করে কোর্টে চালান দেয়া হয়। ফলে সিন্ডিকেটের মূল হোতারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার
বাইরে। এ ছাড়া পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিনিয়ত আসা
বিভিন্ন আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যসমূহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর দিয়ে বহন করা
হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে অনেকের
ক্ষেত্রে অভিযান সফলতার মুখ দেখে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম
থেকে ঢাকা নেয়ার পথে মালবোঝাই ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ থেকে এসব পণ্য
লুট করে একটি চক্র। হাইওয়ে পুলিশ গঠনের পর বছর দুয়েক এ ধরনের অপরাধ কমলেও
গত এক বছর ধরে তা আবার বেড়ে গেছে। এর আগে গত ২০০৮ সালে পণ্য লুট ও গাড়ি
ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ৪০টি। চোরাই পণ্য আটক করা হয়েছে ১০ কোটি টাকার। আটক
হয়েছে ১৫ দুর্বৃত্ত। প্রাইভেট কার উদ্ধার করা হয়েছে ৩টি। চট্টগ্রাম পরিবহন
মালিক সমিতি, চট্টগ্রাম চেম্বার, আন্তঃজেলা কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক মালিক
সমিতি এ ধরনের অপরাধ বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজি, ডিআইজিকে চিঠিও
দিয়েছে।
সূত্র জানায়, বিদেশ হতে আমদানিকৃত পণ্যাদি চট্টগ্রাম বন্দর
থেকে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক বা পিকআপযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেয়া
হয়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাপড়, মোটর পার্টস, ইলেক্ট্রনিক্স, চাল, ডাল,
গার্মেন্টস সামগ্রী ইত্যাদি। এসব পণ্য নিয়ে যাওয়ার পথে লুট করা হয়। ক্ষেত্র
বিশেষে পুরো গাড়িসহ ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা যায়, ফেনী, সীতাকুণ্ড,
ভাটিয়ারি ও মীরসরাই-চৌদ্দগ্রামভিত্তিক একাধিক অপরাধীচক্র রয়েছে। এসব
সিন্ডিকেটে অর্ধ সহস্রাধিক সদস্য রয়েছে। রাতের বেলায় পণ্য বোঝাই যানবাহন
যাওয়ার পথে মোহাম্মদ আলী, লালপুল, চৌদ্দগ্রাম, মহিপাল, মিয়াবাজার,
সীতাকুণ্ড, কুমিরা, বাড়বকুণ্ড, ছোট কমলদহ, বারৈয়ারহাট, মিঠাছড়াসহ বিভিন্ন
স্পটে থামিয়ে পণ্য বোঝাই গাড়ি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পণ্য
নামিয়ে তারপর গাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে পুরো পণ্য বা অর্ধেক পণ্য
লুট করা হয়। এসব পণ্য হালিশহর, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, এলাকায় তাদের নির্ধারিত
গুদামে রেখে পরে বিক্রি করা হয়।
আন্তঃজেলা কাভার্ড ভ্যান ট্রাক মালিক
সমিতি সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে শতকোটি টাকার পণ্যবাহী দেড় শতাধিক ট্রাক
লুটের ঘটনা ঘটেছে। ট্রাক ছিনতাই করা হয়েছে ৩২টি। যার একটিও উদ্ধার করা
সম্ভব হয়নি। কতিপয় ট্রাক চালক ও হেলপারের সঙ্গে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের
যোগসাজশ রয়েছে। পণ্য নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হওয়ার আগেই তাদের জানিয়ে দেয়া হয়।
পরবর্তীতে রাস্তায় পণ্য লুট করা হয়। এ সময় চালক ও হেলপারের ওপর হামলার
‘নাটক’ও সাজানো হয়। এ ছাড়া কতিপয় ট্রান্সপোর্ট মালিক কর্মচারীর সঙ্গেও
তাদের গোপন সমঝোতা রয়েছে। এ কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্য বহনরত যানবাহন
বাদ দিয়ে শুধু পণ্যই লুট করা হয়।
গত ১৫ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম বিএসআরএম
থেকে প্রায় ৩৫ টন রড নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে ফেনীর ফাজিলপুর নামক স্থানে লরির
চাকা ফেটে গেলে ওই সুযোগে ছিনতাইকারীরা চড়াও হয়। ফেনী গোয়েন্দা পুলিশ
পরিদর্শক ফজলুল করিম সেলিম সাপ্তাহিক-কে জানান, ‘পরবর্তীতে ১৮ আগস্ট ভোরে
ওই মালামাল ফুলগাজী থানার নির্মাণাধীন ভবন থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায়
শাহ আমানত ট্রান্সপোর্টের পক্ষ থেকে চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে ফেনী থানায়
মামলা হয়েছে। চালক শিহাব উদ্দিন শামীমকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও হেলপার রশিদ
মোল্লা পলাতক।’
পুলিশের ধারণা ওই ভবনের ঠিকাদার ফুলগাজী চেয়ারম্যান
একরামুল হক একরাম ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এর আগে মহিপাল থেকে যাত্রীবেশে উঠে
এক সিএনজি চালককে সদর উপজেলার সুন্দর নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। খবর পেয়ে
পুলিশ তাকে আহত অবস্থায় গাড়িসহ উদ্ধার করে।
এদিকে, চলতি বছরের ১২
জানুয়ারি মহাসড়কে পণ্য লুটের অন্যতম অভিযুক্ত সায়েদসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে
পুলিশ। গ্রেফতারকৃত সায়েদ ডাকাতির পণ্য পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারও
করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, গাড়ি চালকদের হাত করে তারা পণ্য লুট করে।
কোনো চালক তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে তাদেরকে খুন করা হয়। অল্প দিনে
সায়েদ জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছিনতাইকারী দল বছরে শতাধিক গাড়ি ছিনতাই করে এ মহাসড়কে। বিশেষ করে কুমিল্লা,
দাউদকান্দি, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর মোহাম্মদ আলী ও লালপুল, মীরসরাইয়ের
মস্তাননগর বাইপাস ও বড়দারোগাহাট এলাকায় গাড়িগুলো ছিনতাই করা হয়। এসব এলাকায়
ছিনতাইকারীরা আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকে। প্রাইভেটকার চালক বা মালিক গাড়ি
নিয়ে পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি করে চা-নাস্তা খেয়ে গাড়িতে ওঠার সময় হামলা করে
গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়।
জানা যায়, সিএনজি চালিত ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার
এমনকি ট্রাকও ছিনতাই করে নিয়ে যায় তারা। চালকরা স্বেচ্ছায় চাবি দিতে না
চাইলে মারধর করে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইকারীদের হাতে গত ৫ বছরে ২০ জন
প্রাইভেটকার ও ট্রাক চালক নিহত হয়েছে। ছিনতাই হওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে পুলিশ
গত এক বছরে মাত্র ৩টি প্রাইভেট কার উদ্ধার করা হয়েছে। মহাসড়কে পণ্য ও গাড়ি
ছিনতাইরোধে হাইওয়ে পুলিশ প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০৪ সালে। এরপর পণ্য ও গাড়ি
ছিনতাই কমলেও ইদানীং আবার তা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানিকারক সমিতির হিসাব মতে,
২০০৫ ও ২০০৬ সালে ১৩০ থেকে ১৪০ কোটি টাকার পণ্য লুট করা হলেও ২০০৮ সালে তা
একশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
সমিতির কর্মকর্তা আব্দুর রহমান সাপ্তাহিক-কে বলেন, ‘ঐ মহাসড়কে চলার সময় আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন আমাদের পণ্য লুট হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে
জানা গেছে, পণ্য ও গাড়ি ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা কোটিপতিতে পরিণত হয়েছে
তাদের রয়েছে বাড়ি, গাড়িসহ বিশাল সহায়-সম্পত্তি। মীরসরাই, জোরারগঞ্জ হাইওয়ে,
নিজামপুর হাইওয়ে, কুমিল্লা হাইওয়ে ও সীতাকুণ্ড থানার এক শ্রেণীর পুলিশ
সদস্যের সঙ্গে তাদের রয়েছে সখ্য। এ কারণে সহজে তারা ধরা পড়ে না। আন্তঃজেলা
কাভার্ড ভ্যান ট্রাক মালিক সমিতির পক্ষ থেকে পণ্য ও গাড়ি ছিনতাই রোধে
পদক্ষেপ নেয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ করা হয়েছে। আন্তঃজেলা ডাকাতদের
গ্রেপ্তার করা হলে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ হবে। চেম্বারের পক্ষ থেকেও পণ্য লুট
বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
চট্টগ্রাম পরিবহন
মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল বাহার অভিযোগ করে সাপ্তাহিক-কে জানান, আইন
শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নাকের ডগায় এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে তারা
কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ে
চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে নুরুল বাহারের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন
সাপ্তাহিক-কে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ধরনের অপরাধ আগের চেয়ে অনেক
কমেছে। হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশও কাজ করে যাচ্ছে।’
র্যাব-৭
এর সিনিয়র এএসপি অনির্বাণ চাকমা সাপ্তাহিক-কে বলেন, ‘মহাসড়কে পণ্য
ছিনতাইরোধে আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। ফেনী ক্যাম্পের র্যাব সদস্যরা
রাস্তায় টহল দেয়। আমরা সব সময় মহাসড়কে নজর রাখি। পণ্য ছিনতাই আগের তুলনায়
কমেছে বলে তিনি দাবি করেন।’
ফেনী পুলিশ সুপার ইমাম হোসেন সাপ্তাহিক-কে
জানান, ‘মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক, পণ্য লুটপাট ও ছিনতাই-চাঁদাবাজি রোধে
পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। পুলিশ তার সাধ্যমতো কাজ করছে। আগের থেকে পণ্য
পরিবহনকারীরা এখন অনেক বেশি নিরাপদ।’
মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন