ফেনীর মেয়ে নুসরাত

(১৫ এপ্রিল ২০১৩) প্যারাস্যুট দিয়ে যুগলভাবে আকাশ থেকে নেমে এলেন এক সেনা দম্পতি। নীল আকাশের শূন্যে উড়ে উড়ে তারা উপভোগ করলেন অসাধারণ ও রোমাঞ্চকর সময়। পেশাই তাদের পরিণত করেছে ‘আকাশ দম্পতি’তে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম যুগল ছত্রীসেনা দম্পতির খ্যাতি আর নারীর অগ্রযাত্রায় আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে অনেকগুলো রেকর্ড ঘরে তুলেছেন তারা।

তিন হাজার ফুট উচ্চতায় যুদ্ধবিমান থেকে যুগলভাবে লাফ দিয়ে মাটিতে একইসঙ্গে অবতরণ করে ১১ এপ্রিল সিলেটের পানিছড়া ড্রপজোনে এ রেকর্ড গড়েন মেজর মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হক ও মেজর নুসরাত নুর আল চৌধুরী দম্পতি।

দুইজনই জালালাবাদ সেনানিবাসের সেনা কমান্ডো।

আইএসপিআর এটিকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য একটি বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। নববর্ষের সন্ধ্যায় জালালাবাদ সেনানিবাসের নিজ ভবনে একান্তে কথা বলেছেন এই আকাশ দম্পতি।

দেশে বিদেশে সেনা জীবনের রোমাঞ্চকর নানা ঘটনা উঠে আসে তাদের সঙ্গে আলাপে।

নুসরাত বর্তমানে স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাক্টিসের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট শাখায় জিএসও-২ হিসেবে কর্মরত। স্বামী মেজর মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে ৪৬তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদী কোর্সের সঙ্গে পদাতিক কোরে কমিশন লাভ করেন।

দেশের প্রথম প্যারাট্রুপার দম্পতির খ্যাতি অর্জন করার অনুভূতি কেমন? এ প্রশ্নে দারুণ উল্লসিত মেজর মঞ্জুরুল হক ও মেজর নুসরাত।

‘‘খুব আনন্দ লেগেছে। আকাশে ওড়ার অনুভূতিটাই আলাদা! এ অনুভূতির কথা বলে বোঝানো যাবে না। সবগুলো জাম্প সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে পেশা হিসেবে চ্যালেঞ্জ ও একটি স্বপ্ন যেন বাস্তবায়িত হলো’’-বললেন নুসরাত।

নুসরাতের বাড়ি ফেনী জেলার পশুরাম উপজেলার গুথমা গ্রামে।

ঢাকার মতিঝিল হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর ২০০১ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। নুসরতের বাবা এন আই চৌধুরী ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সচিব।

নুসরাত মনে করেন, সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের কর্মক্ষেত্র রয়েছে। তবে এ জন্য মেয়েদের এগিয়ে আসতে হবে।

সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী প্যারাট্রুপার ও প্রথম প্যারাট্রুপার দম্পতি হিসেবে তাদের খ্যাতির পর অনেক নারী সেনাসদস্য এখন প্যারাস্যুট জাম্পে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানালেন নুসরাত।

তার ভাষায়, ‘‘অনেকেই আগ্রহী হয়েছেন। আগামী বছর হয়ত প্যারাট্রুপার হিসেবে আরও বেশ কয়েকজন নারীকে পাওয়া যাবে, যারা ইতোমধ্যে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।’’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তথা দেশে নারীর অগ্রযাত্রার এই সফলতা দেশের পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে এগিয়ে নেবে। পুরুষের সঙ্গে নারীরাও যে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে পারেন- এটা তার একটা প্রমাণ বহন করবে বলে মনে করেন নুসরাত।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় তার এই বিশেষ অর্জনের পেছনে পরিবার ও স্বামীর সমর্থনের কথা বার বার উল্লেখ করেন তিনি।

প্যারাস্যুট জাম্পের ক্ষেত্রে সীমাহীন সহযোগিতা ছিল স্বামী মঞ্জুরুল হকের এবং প্রশিক্ষক ও সার্বিক তত্ত্বাবধান করতে গিয়ে যাদের আন্তরিক সহযোগিতা তাকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে, তাদের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

মেজর নুসরাতের জাম্প প্রশিক্ষণ ও জাম্প পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন এক প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান। আরও ছিলেন মেজর নুরুল হাসিব ও মেজর এম এম তৌহিদুল ইসলাম।

নিজেকে আরও এগিয়ে নিতে চান নুসরাত। মেজর নুসরাত বলেন, ‘‘নারীর ইচ্ছাশক্তি ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা চ্যালেঞ্জ নিতে চান না। তবে পরিবার থেকে সহায়তা পেলে নারীরা আরও ভালো করবে।’’

উলেখ্য, গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নারী ছত্রীসেনা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন আরেকজন নারী ক্যাপ্টেন জান্নাত।

দ্বিতীয় নারী ছত্রীসেনা মেজর নুসরাত ২০০৩ সালের ২ জুলাই এবং মেজর মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ২০০২ সালের ২৬ জুন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

মঞ্জুরুলের বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠি জেলার নবগ্রামে। ঢাকার মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে ১৯৯৮ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

বাংলানিউজকে মেজর মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘‘নারীদের মধ্যে অসীম সম্ভাবনা, সংকল্প ও কঠিনকে জয় করার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের উজ্জীবিত করতে পরিবারের সহায়তার প্রয়োজন।’’

সেনাবাহিনীতে এ রকম চ্যালেঞ্জিং কোর্সে নারীদের এগিয়ে আসার মতো পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সফলতার পর বাংলাদেশের মেয়েরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে।”

জাতিসংঘ মিশন, সেনা-নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারীর অগ্রযাত্রা বাড়ছে উল্লেখ করে মঞ্জুরুল হক বলেন, “এজন্য নারীদের মনোবল ও পারির্পাশ্বিক সহযোগিতা থাকা দরকার। ফলে, পুরুষের পাশাপাশি বিকশিত হয়ে উঠবে নারীরাও।”

স্ত্রী নুসরাতের সাফল্যে গর্বিত স্বামী মঞ্জুরুল আরও বলেন, “সেনা প্রশিক্ষণ অত্যন্ত কঠিন। দিনের পর দিন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নুসরাত নিজেকে জাম্পের জন্য তৈরি করেছে।”

সেনাজীবনের রোমাঞ্চকর গল্পের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে দেশে এবং দেশের বাইরে কাজ করতে হয়েছে। এর মধ্যে একটা ইউনিক অপরচ্যুনিটি এসেছিল একবার। সপ্তাশ্চর্য আগ্রার তাজমহলের মাত্র একহাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে গেছি।”

সেটা প্রশিক্ষণের অংশ ছিল ও ‘ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স’ বলে মন্তব্য করে বলেন, “তখন হেলিকপ্টারের সঙ্গে আমিসহ ৬ জন সৈন্যকে মোটা একটি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। আগ্রা ও তাজমহলের উপর দিয়ে হেলিকাপ্টার যাওয়ার সময় অসাধারণ যে অনুভূতি তা ভুলবার নয়।”

এছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দারফুরায় দায়িত্ব পালনকালেও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর গৌরবের কথা তুলে ধরে মঞ্জুরুল বলেন, “সেখানে প্রায়ই সন্ধ্যার পর কারফিউ চলতো। কারফিউ চলাকালে অন্যান্য দেশের আর্মিদের ওপর আক্রমণ হলেও বাংলাদেশের কোনো সৈন্য হামালার শিকার হয়নি। এর কারণ বাংলাদেশের সৈন্যদের সবাই ছিল খুবই বন্ধু ভাবাপন্ন। তারা সাধারণের সঙ্গে সহজেই মিশে গিয়েছিল।” বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম অর্জনের পেছনে এটি একটি একটি বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন মেজর মঞ্জুরুল হক।

ব্যক্তিগত জীবনে সুখী দম্পতি মেজর মঞ্জুরুল ও নুসরাতের। ১২ বছর আগে মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট থাকাকালে তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে পরিচিত হন। ২০০৮ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। তার পর দুজনের মিশনে থাকা।

চ্যালেঞ্জিং পেশা হওয়ায় লম্বা সময় একজন আরেকজনের থেকে দূরে থাকলেও তাদের সুখি দাম্পত্য জীবন বজায় থেকেছে।

মঞ্জুরুল বলেন, “কীভাবে সুন্দর সংসার সাজানো যায়, আমরা সবসময় তার চিন্তা করতাম। প্রশিক্ষণ, দায়িত্বপালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় যা কিছু ইউনিক লেগেছে, তা সংগ্রহ করেছি।”

সেনানিবাসে তাদের বাসবভনে এসব স্মৃতিবিজড়িত বস্তুসামগ্রী তারা সাজিয়ে রেখেছেন।


-->