ফেনী নদী দখলের পাঁয়তারা ভারতের

ফেনী নদীতে পাইপ বসিয়ে পানি তুলে নিচ্ছে ভারত
(২ নভেম্বর ২০১২) কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই ফেনী নদী দখলের অপচেষ্টা করছে ভারত। নদীটির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ হলেও ইতোমধ্যে ভারত ফেনী নদীতে সেতু ও স্থলবন্দর নির্মাণ করছে। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

জানা যায়, তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সুরাহা না করেই ফেনী নদীতে সেতু তৈরির ব্যাপারে ভারতকে অনুরোধ জানাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি এ সম্পর্কিত একটি চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফেনী নদীতে সেতু ও ভারতীয় অংশে সংযোগ সড়কসহ অবকাঠামো নির্মাণে ভারতীয় কর্তৃপকে অনুরোধ জানাতে বলা হয়।

সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ি সীমান্তে ফেনী নদীর অংশ বাংলাদেশে পড়লেও এ নদীতে সেতু করার ব্যাপারে ভারতই প্রথম প্রস্তাব দেয়। ফেনী নদীতে সেতু হলে বাংলাদেশের তেগামুখ ও রামগড় স্থলবন্দরের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হবে। দণি-পূর্ব এশিয়ার সাথে সহজে যোগাযোগ গড়ে তুলতে এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা পেতে বহু দিন ধরেই ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ত্রিপুরা দাবি করে আসছিল। এটি হলে সাবরুম তেগামুখ থেকে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব হবে মাত্র ৭২ কিলোমিটার। ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা নিতে পারবে। এ ল্েয ২০১০ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে ঘোষিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী তেগামুখ ও রামগড় স্থলবন্দর চালুর ঘোষণা আসে। আর এ স্থলবন্দর কার্যকর করতে ফেনী নদীতে সেতু করার প্রস্তাব দেয় ভারত। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার কথা ছিল। তবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়ায় ফেনী নদীর বিষয়টি অনালোচিত থেকে যায়। তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে কোনো সুরাহা না হলেও ফেনী নদীতে সেতু করতে ভারতকে অনুরোধ জানানোর জন্য চিঠি লিখেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্র সচিবকে উদ্দেশ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ফারহানা ইসলাম স্বারিত ওই চিঠিটি সম্প্রতি (৯ জুলাই) পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, রামগড়কে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণের ল্েয একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপোয় আছে। অপর দিকে রামগড়ের সাথে ভারতের কোনো সংযোগ সড়ক বা অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। রামগড় সীমান্তে ফেনী নদীতেও সেতু নেই। ভারতের সাথে এ বন্দর দিয়ে বাণিজ্য শুরু হলে সেতু নির্মাণ ও ভারতীয় অংশে সংযোগ সড়ক এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো দরকার। স্থলবন্দর কার্যকর করতে ফেনী নদীতে সেতুসহ অবকাঠামো নির্মাণে ভারতীয় কর্তৃপকে অনুরোধ জানানোর জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হয়।

জানা গেছে, তেগামুখ ও রামগড় স্থলবন্দরের অপর পাশে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার একটি আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট, শুল্ক অফিসসহ বন্দরের কয়েকটি প্রয়োজনীয় পাকা ভবন নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করেছে। সাবরুম-আগরতলা-উদয়পুর সড়কসহ এ মহকুমার সাথে অন্য মহকুমা ও জেলার সড়কের উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সে দেশের সরকার। ১০০ বছর মেয়াদি সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় ৪০ কোটি রুপি। প্রায় ১৫০ মিটার দীর্ঘ এ সেতু এবং স্থলবন্দরের অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ভারত ডিটেইলড প্রজেক্ট প্রতিবেদনও তৈরি করেছে।

সূত্র জানায়, গত জানুয়ারিতে ভারতের আগরতলা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেগামুখ ও রামগড় স্থলবন্দর চালুর সিদ্ধান্তের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। এরই পরিপ্রেেিত ফেনী নদীর ওপর প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণে কারিগরি পরীার ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদন দেয় দেশ দু’টি। সীমান্তবর্তী সাবরুমে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ৪ মে দুই দেশ অনুমোদন দেয়ায় নির্মাণকাজ চূড়ান্ত করে ভারত।

৫ মে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ সেতু নির্মাণ হলে ত্রিপুরাসহ ভারতের গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল যেমন উপকৃত হবে; তেমনি উপকৃত হবে বাংলাদেশও। তবে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সুরাহা না হওয়ায় নেয়া উদ্যোগ থমকে যায়। এরশাদ সরকারের সময় চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফেনীর ছাগলনাইয়া, সোনাগাজীসহ কয়েকটি উপজেলাকে সেচের আওতায় আনতে ফেনী নদীতে বাস্তবায়ন করা হয় মুহুরী সেচ প্রকল্প। অথচ কোনো পানিচুক্তি ছাড়াই নদীর তলদেশে পাইপ বসিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত।

জাতীয় পার্টির লংমার্চ : ফেনী নদীর পানি রার দাবিতে মুহুরী প্রকল্প বাস্তবায়নকারী জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের নেতৃত্বে ৫ মার্চ ঢাকা থেকে ফেনী অভিমুখে লংমার্চ হয়। লংমার্চ শেষে ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জনসভায় এরশাদ বলেন, জীবন দেবো তবু ফেনী নদীর পানি দেবো না। ফেনী নদীর অস্তিত্ব রায় সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।

আজো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি : ফেনী নদী থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহার ও নদীর সীমানা অুণœ রাখতে এখনো কোনো সরকারিপর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ভারত এগোচ্ছে ধীরে ধীরে এই নদীর ওপর সেতু স্থাপনসহ স্থলবন্দর স্থাপনের প্রক্রিয়ায়। কয়েক শ’ ফুট দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে ভারত। সেই ল্েয বিএসএফ ক্যাম্পের বিশেষ নিরাপত্তা পোস্ট বর্ধিতও করেছে ভারত। আগে নদীর ওপারেও ছিল বাংলাদেশের জমি। সেই জমি দখল করে নিয়েছে ভারত। সীমানা এ দিকে ঠেলে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। এখন বলছে, নদীর অর্ধেক ভারতের, অর্ধেক বাংলাদেশের। তবুও বর্ডার গার্ড টহল দিচ্ছে না নদীতে।

নদীতীরবর্তী সীমান্ত এলাকায় সরেজমিন গেলে বাংলাদেশ অংশের অলিনগর আমলিঘাটের বৃদ্ধ আলী আহম্মদ মিয়া (৬৫) বলেন, স্বাধীনতার পরও নদীর ওই পাড়ে ঘর ছিল তার। নদী ভেঙে এ দিকে এসেছে, আর তিনিও ওই পারের পর এ দিকে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এভাবে বাংলাদেশ ভূখণ্ড দখল করছে ভারত। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের টাকায় বাস্তবায়ন করা মুহুরী প্রকল্পের সুফল ভারত নিতে চায় জোর করে।

নদীর উৎপত্তিস্থল নিয়ে ভারতের মিথ্যাচার : বহুল আলোচিত ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশে। ভারত অযথা নদীটির উৎপত্তিস্থল দাবি করছে। দাবি করা হয়, ফেনী আন্তর্জাতিক নদী। বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী এ নদীর উৎপত্তিস্থল ত্রিপুরা রাজ্যে বলে ভারতের দাবি। তবে এ নদীর উৎপত্তি বাংলাদেশের মাটিরাঙ্গার ভগবানটিলায়। নদীর ১০৮ কিলোমিটারের কোনো অংশ ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি।

সরেজমিন দেখা যায়, মিরসরাইয়ের আমলিঘাট সীমান্ত এলাকায় গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে নদীর পাড়ে ব্লক তৈরি করছে ভারত। এই সীমান্তে পাইপ বসিয়ে ভারতের উপেন্দ্রনগরের জন্য পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রামগড়ের অদূরে সাবরুম শহরের পানিসঙ্কট মেটাতে ১৭টি পাইপ বসিয়ে পানি নিচ্ছে ভারত। এ ছাড়া আচালং মৌজায় এক হাজার ৭০০ একর জমি দখল করে রেখেছে ভারত।

এই বিষয়ে মিরসরাই পানি ব্যবস্থাপনা ফোরামের সভাপতি ডা: জামশেদ আলম জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি উপজেলার মধ্যবর্তী ভগবানটিলা নামে একটি পাহাড় থেকেই এ নদীর যাত্রা শুরু। পাহাড়ের ছড়া থেকে উৎপত্তির পরপরই নদীটি বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ইজেরা গ্রামে প্রবেশ করে। ইজেরা গ্রাম থেকেই নদীটি ফেনী নদী নামে পরিচিত। দুই দেশের সীমান্ত ঘেঁষে বেশ কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর নদীটি মিরসরাইয়ের আমলিঘাটে করেরহাট ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা ছুয়ে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।

এ দিকে ফেনী নাগরিক সমাজ ও মিরসরাই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ফোরাম ফেনী নদীকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে রার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে।




-->